ওষুধের দোকান থেকে কোনো ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা না করেই ইচ্ছে মতো ওষুধ কিনে খাওয়া একটি সাধারণ এবং প্রায়ই চিকিৎসা না করে রোগ-গত সমস্যা মোকাবিলার সস্তা এবং চট-জলদি উপায়। অন্যদিকে, স্ব-ওষুধ-সেবন হল কোনও উপযুক্ত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করেই কোনও রোগের ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস। ডায়াবেটিস রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা ব্যয়-সঙ্কোচ, বন্ধুর পরামর্শ, ইত্যাদি সহ আরও বিভিন্ন কারণে স্ব-ওষুধ-সেবনের বিকল্প গ্রহণ করেন, কারণ নির্বিশেষে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ খাওয়ার এই অভ্যাস, হোক না তা অ্যালোপ্যাথিক, ভেষজ ওষুধ বা খাদ্য পরিপূরকও হতে পারে[1], য়েই সব ধরনের স্ব-ওষুধ-সেবনেই শরীরের খুব ক্ষতি হতে পারে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় 40% রোগী স্ব-ওষুধ-সেবন করে থাকেন।[2] মজার বিষয় হল, পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই স্ব-চিকিৎসা ও স্ব-ওষুধ-সেবন করার সমান সম্ভাবনা রয়েছে এবং উচ্চ-শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এই প্রবণতার বাইরে নন। নিম্নলিখিত কারণগুলির মধ্যে একটি (বা আরও বেশি) কারণে সাধারণত কোনও ব্যক্তি স্ব-চিকিৎসা ও স্ব-ওষুধ-সেবন করে থাকে:
ডাক্তারদের প্রতি অবিশ্বস্ত হলে
যে সকল রোগীরা তাদের ডাক্তারদের প্রতি কোনমতেই আস্থা রাখতে পারেন না তাদের চিকিৎসাগত তদারকি ছাড়াই ডায়াবেটিস রোধী ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি রয়েছে।
পরিবারের সদস্য বা বন্ধু যখন এমন প্রস্তাবনা বা সুপারিশ করেন
প্রায়ই দেখা যায়, রোগীরা তাদের বন্ধু বা পরিবারের পরামর্শের ভিত্তিতে ওষুধগুলি ব্যবহার করেন, বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস রোগও হতে পারে এবং তারাও একটি নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন করতে শুরু করেন। এই অভ্যাস ভয়ানক ক্ষতিকারক হতে পারে কারণ ওষুধটি সেই রোগীর পক্ষে উপযুক্ত নাও হতে পারে।
কাজের পরিবেশে খুব ব্যস্ত থাকাকালীন
যেসব রোগীরা বিশ্বাস করেন যে তারা ডাক্তারদের দেখাতে যেতে বা ওষুধের রিফিলগুলি কিনে নিতে খুব ব্যস্ত তাদেরই মধ্যে স্ব-চিকিৎসা ও স্ব-ওষুধ-সেবন করার ঝুঁকি বেশি। ডাক্তার সেই সব রোগীদের নিয়মিত চেকআপ না করতে পারায় অন্যান্য রোগ সংক্রান্ত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও, কিছু রোগী একটি সন্দেহজনকভাবে খ্যাতনামা অনলাইন ফার্মেসীগুলিতেও যেতে পারে, যেখানে ওষুধগুলি জাল হওয়ার বা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ত্রুটিযুক্ত হওয়ার অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে আসে।
রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা করাবার ব্যয়-সঙ্কোচের প্রবণতা
সাধারণত ডাক্তারদের পরামর্শের উচ্চ ব্যয় এড়াতে কিছু লোক স্ব-চিকিৎসা ও স্ব-ওষুধ-সেবন করার দিকে ঝোঁকেন।
ডায়াবেটিস রোগের নিরাময়ে দীর্ঘ সময় লাগে
ডায়াবেটিক অবস্থার পরিচালনা সারা জীবনের জন্যই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং এই দীর্ঘ সময়কাল পরোক্ষভাবে ব্যক্তিকে স্ব-চিকিৎসা ও স্ব-ওষুধ-সেবন করার দিকে নিয়ে যায়, আংশিকভাবে সময়ের সাথে উত্তরোত্তর ওষুধ কেনার কারণে ব্যয় বৃদ্ধি এবং আংশিকভাবে রোগের দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃতির জন্য হতাশার কারণে এবং প্রকাশিত লক্ষণগুলির থেকে কোনো ত্রাণের আশা না দেখে তারা এমন করে থাকেন।
স্ব-চিকিৎসা ও স্ব-ওষুধ-সেবন কী কী কারণে একটি খারাপ ধারণা হিসাবে পরিচিত হয়েছে?
আপনার রোগাবস্থা অনুসারে স্ব-ওষুধ-সেবন করা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে। ডাক্তার রোগীকে দেখে নির্ধারণ করেননি এমন কোনো ওষুধ রোগী নিজের ইচ্ছে মত খেলে তার রোগের সামগ্রিক অবস্থার সাথে তা মোটেও মেলে না, যাতে রোগীকে সুবিধা করে দেওয়ার কথা তো দূরস্থান বরং দীর্ঘমেয়াদে এতে রোগীর আরও বেশি ক্ষতিই করতে পারে। এছাড়াও, ডাক্তাররা সাধারণত ওষুধ সেবনের এক নির্দিষ্ট মাত্রা (কত) বলে দেন এবং সেই নির্দিষ্ট মাত্রা (দিনে কখন এবং কত বার সেবনের দরকার) এবং স্বতন্ত্রভাবে রোগীর ব্যক্ত প্রতিক্রিয়ার প্রতি নির্ভর করে আপনার ডাক্তার ওষুধগুলি সেবনের এই হিসাব নির্দিষ্ট করে থাকেন; সঠিক চিকিৎসা ও তদারকি না করা হলে ওষুধগুলি সেবনের এই প্রকার ব্যক্তিগতকরণ হারিয়ে যায়। অতিরিক্তভাবে, যে কোনও ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য ওষুধের সাথে এর ক্রস-প্রতিক্রিয়াগুলির ঝুঁকিও তো রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, কোনো রকম চিকিৎসাজনিত তদারকি ছাড়াই ওষুধগুলি মিশিয়ে সেবন করলে (এমনকী যেমন ধরুন,, একটি ডাক্তারের দেওয়া নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধের সাথে আরেকটি নিজের ইচ্ছে মতো দোকান থেকে কিনে নেওয়া ওষুধ সেবন) দুটি ওষুধের যা কিছু ক্ষতিকারক মিথস্ক্রিয়াগুলির কারণে মারাত্মক রোগ সম্পর্কিত জটিলতার সূচনা করতে পারে, যা ড্রাগ-ইন্টারঅ্যাকশন হিসাবে পরিচিত। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি 7 জন বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্তত একজন আছেনই যে এইভাবে ওষুধ মিশ্রিত করে হামেশাই সেবন করেন। তারা ভাবেনও না যে তাদের মধ্যে ওষুধজনিত প্রতিক্রিয়া এবং এই সম্পর্কিত জটিলতার সূচনা হওয়ার কতটা বড়ো ঝুঁকিতে রয়েছে।[3]
খুব সাধারণ একটি ভুল ধারণা হল যে কোনো ভেষজ ওষুধই সমস্ত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত। মজার ব্যাপার হল এই ভুল ধারণা নিয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে বহু লোকজন না জেনে না বুঝে কমপক্ষে একবার তো এই সমস্ত ভেষজ ওষুধ ব্যভার করার চেষ্টা করার জন্য মুখিয়ে থাকে। যদিও সেগুলির মধ্যে কিছু ভেষজ ওষুধের কাজ করার প্রমাণ রয়েছে তবে কোনও প্রবিধান বা তদারকি ছাড়াই সেগুলি সেবন কয়রা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সমতুল্যই হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস রোগীরা এই রোগ নিরাময়ে ভেষজ স্ব-ওষুধের বিপদ সম্পর্কে আমাদের নিবন্ধটি দেখুন।
ভারতের মতো অন্যান্য বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে ওষুধ সম্পর্কিত কোনো শক্তিশালী বা সরকারী সতর্ক-প্রহরার ব্যবস্থা নেই এবং স্থানীয় রসায়নবিদ ও ওষুধের দোকানগুলির ফার্মাসিস্টরা স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং এবং স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যজনিত প্রচারে খুব কম ভূমিকা পালন করে। এটি ডাক্তারদের কাছে ফলোআপ ভিজিট অপরিহার্য করে তোলে। কোনো রোগ হলে ডাক্তারদের কাছে সেটি দেখানো এড়ানো হলে, এই সব ক্ষেত্রে রোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা চ্যালেঞ্জিং বা একেবারেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। আপনি হয়ত জানেন না যে আপনি ঠিকঠাক ওষুধ সেবন করছেন কিনা বা আপনার অবস্থার অবনতি ঘটলে আপনার সেবন করা ওষুধের হয়তো মাত্রা কমিয়ে আনা দরকার এবং সম্ভাব্য দূর্বলতাজনিত জটিলতাগুলি রোধ করার জন্য অতিরিক্ত পরীক্ষা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন।
স্ব-ওষুধ-সেবন এড়ানো
চিকিৎসা তদারকি ছাড়াই ওষুধ গ্রহণ বা মিশ্রণ অপেক্ষাকৃত সামান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্যও ক্ষতিকারক তো বটেই, আর সেখানে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য (বা আরও অন্যান্য জটিল রোগগুলির জন্য) এমনটা কয়রা ভয়ানক বিপজ্জনক হতে পারে। আপনার বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা মিডিয়া যা বলছে তার ভিত্তিতে ওষুধ খাবেন না। যদি কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ সেবনে ফল হয়ও তবে সেটিও সেবনের আগে একবার অন্তত আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।হয়তো তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব হবে না, তবে এটি আপনার কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ তা তাঁকে ব্যাখ্যা করে বোঝাবার চেষ্টা করুন এবং ওষুধগুলির বদলের ব্যাপারে এবং সংমিশ্রণের বিষয়ে তাদের মতামত জিজ্ঞাসা করুন। ডায়াবেটিসের উপযোগী নিয়ন্ত্রণে ওষুধগুলি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, জটিলতার সূত্রপাত করার ব্যাপারে প্রতিরোধ করতে না পারলেও কমপক্ষে রোগাবস্থার অবনতি অবশ্যই বিলম্বিত হতে পারে। ভবিষ্যতে ডায়ালাইসিসের জন্য নিয়মিত ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে এখন থেকেই নিয়মিত ডাক্তার দেখানো এবং চেকআপগুলিতে সময় এবং অর্থ উভয়ই ব্যয় করা উপযুক্ত কাজ হবে বলে মনে হয়। সর্বদা আপনার সমস্ত প্রশ্ন এবং সন্দেহ সম্পর্কে আপনার ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞাসা করতে বা পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
সূত্র:
- You JH, Wong FY, Chan FW, Wong EL, Yeoh EK. Public perception on the role of community pharmacists in self-medication and self-care in Hong Kong. BMC clinical pharmacology. 2011;11(1):19. Available at: https://bmcclinpharma.biomedcentral.com/articles/10.1186/1472-6904-11-19
- Rezaei M, Safavi AR, Alavi NM, Kashefi H. Study of Self Medication In Patients With Diabetes Using Path Analysis. Journal of Diabetology &58; Official Journal of Diabetes in Asia Study Group. 2015;6(3):2. Available at: http://www.journalofdiabetology.org/temp/JDiabetol632-8622245_235702.pdf
- Qato DM, Wilder J, Schumm LP, Gillet V, Alexander GC. Changes in prescription and over-the-counter medication and dietary supplement use among older adults in the United States, 2005 vs 2011. JAMA internal medicine. 2016;176(4):473-82.